বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের স্বীকারোক্তি মূলহোতার

বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের স্বীকারোক্তি মূলহোতার, টাঙ্গাইলের মধুপুরে কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা ঈগল পরিবহনের বাসে ডাকাতি ও দলবদ্ধ-ধর্ষণের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত রাজা মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাজা মিয়া ওই ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

বৃহস্পতিবার (৪ আগষ্ট) ভোরে তাকে টাঙ্গাইল শহরের দেওলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশি সূত্র জানিয়েছে, অন্য আসামীদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় গণধর্ষণের শিকার ওই নারীকে ধর্ষণের প্রাথমিক আলামত মিলেছে।

বৃহস্পতিবার রাজা মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠায় পুলিশ। এ ছাড়াও ধর্ষণের শিকার হওয়া ওই নারী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

রাজা মিয়া কালিহাতী উপজেলার বল্লা গ্রামের হারুন অর রশিদের ছেলে। টাঙ্গাইল শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতো।

পুলিশ জানায়

পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার (২ আগস্ট) সন্ধ্যায় কুষ্টিয়ার বরাইগ্রাম থেকে ২৪ জন যাত্রী নিয়ে ঈগল পরিবহনের বাসটির যাত্রা শুরু করে। রাত সাড়ে ১১টার পর সিরাজগঞ্জে রাতের খাবারের যাত্রা বিরতি দেওয়া হয়। এরপর কড্ডার মোড় এলাকা থেকে তিন ধাপে যাত্রী সেজে ১০ জন ডাকাত ওই বাসে ওঠে।

চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে আসা বাসটি রাত সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়। অনেক যাত্রী তখন ঘুমাচ্ছিলেন। এরপরই শুরু হয় ডাকাতদের তৎপরতা। যাত্রীবেশী ডাকাতরা শুরুতেই অস্ত্রের মুখে ঘুমন্ত যাত্রীদের হাত, মুখ, চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, টাকা, স্বর্ণালংকার লুটে নেয়। পরে ডাকাত দলের সদস্যরা গাড়িতে থাকা নারীদের নির্যাতন করে। এক নারীকে ছয় জন ডাকাত বাসের মধ্যে দলবদ্ধ-ধর্ষণ করে।

টানা তিন ঘণ্টা যাত্রীদের ওপর চালানো নির্যাতনের পর, রাত ৩টা ২৫ মিনিটে মধুপুরের রক্তিপাড়া নামক স্থানে এসে বাসটির গতি কমিয়ে ডাকাত দল নেমে যায়। যাত্রীদের নিয়ে বাসটি রাস্তার পাশের বালুর স্তুপে ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে পড়ে। এই শব্দ শুনে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে যাত্রীদের উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় বাসের যাত্রী কুষ্টিয়ার হেকমত আলী বাদী হয়ে মধুপুর থানায় ডাকাতি ও ধর্ষণের মামলা করেন।

বাসটির যাত্রী ও নাটোরের বড়াইগ্রামের বাসিন্দা- ফল ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান জানান, তিনি মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে নাটোরের তরমুজ চত্বর থেকে বাসে ওঠেন। বাসটি সিরাজগঞ্জের কাছাকাছি দিবারাত্রি হোটেলে নৈশভোজের বিরতি দেয়। তখন বাস থেকে নেমে অনেকেই ওই হোটেলে খাবার খায়। কড্ডার মোড়ে আসার পর গেঞ্জি-শার্ট পরা ১০-১২ জন যাত্রী ওঠে বাসে। তাদের প্রত্যেকেরই পিঠে ব্যাগ ছিল। তারা বাসের খালি সিটগুলোতে বসে পড়ে।

তিনি আরও জানান, বাসটি দ্রুতগতিতে চলছিল। বাসটি বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর যাত্রীবেশে থাকা ডাকাত দল ঘুমন্ত যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর একে একে সব যাত্রীর হাত, চোখ, মুখ বেঁধে ফেলা হয়। শিশুদেরও একই কায়দায় বেঁধে রাখে তারা। লুটপাট চালানোর পর নারী যাত্রীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।

‘হাত বাঁধা থাকায়- আমরা কিছুই করতে পারিনি ! আমার পাশে বসা এক নারীকে চার দফায় ধর্ষণ করা হয়েছে’ – হাবিবুর রহমান বলেন।

অপর যাত্রী বলেন

অপর যাত্রী দৌলতপুর থানার তারাগুনিয়া গ্রামের শিল্পী বেগম বলেন, ‘অসুস্থ মেয়েকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের সবাইরে হাত, মুখ, চোখ বাইন্দা ডাকাতরা সব লুট কইরা নিছে। আমার স্বামী পিয়ার আলীকে ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। আমার কাছ থিকা ৩০ হাজার টাকা নিয়া গেছে’। বাসে থাকা অন্য নারী যাত্রীরাও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুনঃ শোকাবহ আগস্ট শুরু

বেসরকারি চাকরিজীবী নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা আবদুর রশিদ নাটোর থেকে বাড়ি যাচ্ছিলেন অসুস্থ মাকে দেখার জন্য। তিনি বলেন, ‘বেতনের ২২ হাজার ৮০০ টাকা কাছে ছিল। ডাকাতরা সেই টাকা নিয়ে গেছে’।

এদিকে দলবদ্ধ-ধর্ষনের শিকার নারীর ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত মিলেছে। টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে বৃহস্পতিবার দুপুরে তার ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। পরে তাকে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য আদালতে পাঠানো হয়।

ধর্ষণের শিকার হওয়া ওই নারী জানান, ডাকাতির প্রতিবাদ করায় ছয় জন ডাকাত পালাক্রমে তাকে ধর্ষণ করে। ডাকাতদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসি দাবি করেন তিনি।

গাইনি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক জানান

মেডিকেল বোর্ডের প্রধান শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক রেহেনা পারভীন জানান, ওই নারীকে তিন সদস্যের মেডিকেল টিম পরীক্ষা করেছেন। তিনি বলেন পরীক্ষায় ‘কিছু সাইন পজিটিভ এসেছে। সাইন অব স্ট্রাগল রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তার সোয়াব সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে’।

টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার বলেন, ‘ঈগল পরিবহনের যে বাসটি ডাকাতদের কবলে পড়ে, সেই বাসের চালককে সরিয়ে দিয়ে রাজা চালকের সিট দখল করে। রাজা বাসটি মির্জাপুরের গোড়াই আন্ডারপাসের নিচ দিয়ে ইউটার্ন নিয়ে- আবার এলেঙ্গা হয়ে মধুপুরের দিকে যায়। এই সময়ে তারা যাত্রীদের সব লুটে নেয় ও এক নারীকে ধর্ষণ করে’।

পুলিশ সুপার আরও জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ ঘটনায় কে কে জড়িত ছিল রাজা তাদের নাম জানিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত রাজা মিয়ার কাছ থেকে দুইটি চাকু, একটি কাঁচি এবং যাত্রীদের কাছ থেকে ডাকাতি হওয়া তিনটি মুঠোফোন সেট উদ্ধার করা হয়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাজা মিয়া এই ডাকাতির ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

তিনি জানান, মধুপুরে বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান শুরু করে পুলিশ। ভোরে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top