কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের মতো রাজনীতিতে আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারও সমান পরিচিত। আলোচিতও বটে। কুমিল্লার বাহার যে কারণে আলোচিত, কুমিল্লার রাজনীতির অনেক কলকাঠি তার হাতে। তাতে কুমিল্লা-৬ আসনের এই সংসদ সদস্যের সঙ্গে পেরে ওঠেন না জেলার বাকি সাংসদরা, এই অভিযোগও বেশ পুরনো। সেসব প্রায়শই পত্রিকায় খবর হয়। শুধু কুমিল্লাতেই নয়, সারা দেশেই পরিচিতি আছে তার।
২০১২ সালে অনুষ্ঠিত হয় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন। ওই নির্বাচন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন কুমিল্লার প্রয়াত বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খান। বাহারের পুরনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে পরাজয় হয়েছিল আফজল খানের, এ কথা মানেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও। বাহারের ‘রাজনৈতিক শিষ্য’ বলে পরিচিত বিএনপির নেতা মনিরুল হক সাক্কুর গলায় ওঠে জয়ের মালা।
আফজল খান প্রয়াত হলে ২০১৭ সালে তার মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে নৌকা প্রতীক দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু তাকেও পরাজিত হতে হয়। এবারও সাক্কুই পান জয়ের স্বাদ। আবারও সেই বাহারই তার ত্রাতা ছিলেন বলে প্রচার আছে।
বাহাউদ্দিন বাহারের কারসাজি
অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বের কারণে দলের প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে বাহাউদ্দিন বাহারের কারসাজির অভিযোগ পৌঁছেছিল দলের কেন্দ্রেও। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেক নেতাও বাহারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। নাম উল্লেখ না করলেও, দলীয় প্রার্থীকে হারানোর পেছনে যে বা যার হাত আছে ‘তাদের কোনো ছাড় নয়’ বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন ওবায়দুল কাদের। কিন্তু শেষতক তেমন কোনো খগড় বইতে হয়নি বাহারকে।
এবারও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আলোচনার তুঙ্গে বাহাউদ্দিন বাহার। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, কোনো সংসদ সদস্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রচারে অংশ নিতে পারেন না। সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ভোটার হলে শুধু ভোট দিতেই নির্ধারিত কেন্দ্রে যেতে পারেন।
কিন্তু সংসদ সদস্য বাহার আইন ভেঙে দলীয় প্রার্থী রিফাতের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ ওঠে। তাকে সতর্ক করে নির্বাচন কমিশন। তাতে কাজ না হওয়ায় গত বুধবার তাকে এলাকা ছাড়তে নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন।
প্রথম দফা সতর্কবার্তা পেয়েই আদালতে গিয়েছিলেন বাহার। তাকে নির্বাচনের প্রচারে সুযোগ না দেওয়া কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। ইসির নির্দেশ পাত্তা না দিয়ে এখনো কুমিল্লাতেই আছেন বাহার।
এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়ার পর বাহার কেন যাচ্ছেন না?
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের আর তেমন কিছু করার নেই, বাহাউদ্দিন বাহার এলাকা না ছাড়লে।’
নির্বাচন কমিশনের আপাত এই ‘অপারগতা’ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চললেও বাহার আছেন বহাল তবিয়তে। তিনি দৃশ্যত নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ না নিলেও নিয়মিত দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতকে জয়ী করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন। রিফাত তার ফুফাতো ভাই, রাজনৈতিক শিষ্যও বটে।
read more: ‘পদ্মা-মেঘনা’ নামেই নতুন বিভাগ, “পদ্মা বিভাগের হেডকোয়ার্টার হবে ফরিদপুর”
কুমিল্লার আওয়ামী লীগের রাজনীতিই শুধু নয়, গোটা জেলার রাজনীতিতে বাহার গুরুত্বপূর্ণ এক মুখ। বিএনপির নেতা মনিরুল হক সাক্কু অকপটে স্বীকার করেছেন, গত দুই মেয়াদে মেয়র পদে দায়িত্বপালনের সময় তিনি বাহারের সঙ্গে মিলে সিটি করপোরেশন চালিয়েছেন। তার সঙ্গে বাহারের ঘনিষ্ঠতার কথাও জানেন কুমিল্লার রাজনৈতিক অঙ্গনের সবাই।
তবে এবারের নির্বাচনে বাহার এবং সাক্কুর মধ্যকার দ্বন্দ্ব এসেছে প্রকাশ্যে। রিফাতের পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠে নেমে বাহার জানান দিয়েছেন সাক্কুকে এবার তিনি নগর ভবনে দেখতে চান না। এজন্য সাক্কুর বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগও তুলেছেন এই সাংসদ। সাক্কুরও দাবি, ভোটে না দাঁড়ালে বাহারের কাছে তার চেয়ে ‘ভালো’ কেউ হতো না।
কুমিল্লা মহানগর কমিটির শুরু থেকে সভাপতির দায়িত্বে আছেন বাহাউদ্দিন বাহার। ২০০৮ থেকে তিনি টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি।