২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তখন থেকে একের পর এক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে চলেছে। রূপকল্প ২০২১ ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। সামনে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ রয়েছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হবে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। শেখ হাসিনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ রাখতে শতবর্ষীয় ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ ঘোষণা করেছেন।
জনকল্যাণমুখী সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতা রাষ্ট্র পরিচালনা করলে কোনো ষড়যন্ত্রই যে জাতিকে পেছাতে পারে না, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শেখ হাসিনা। নানা সময়ে নানা ষড়যন্ত্র শেখ হাসিনাকে দমাতে পারেনি। তিনি সব প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে সফলভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছেন। পদ্মা সেতু শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন নয়, এটা ছিল বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্ন। একটি সেতু আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয়, যোগ্যতা সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সাহসী প্রচেষ্টা ও প্রত্যয়ের ফসল। বছরের পর বছর কষ্টের পর প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে সেতু তৈরীর এই সুন্দর স্বপ্ন এখন বাস্তবায়ন হয়েছে।
প্রথমে স্বপ্নটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করলেন তার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু এখন শুধুমাত্র একটি অবকাঠামো নয়, এটা বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক, আত্মমর্যাদার প্রতীক, এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। দেশের অন্যতম অহংকার ও গৌরবের প্রতিক। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন বাঙালির গর্বের আরেকটা নতুন সংযোজনের নাম পদ্মা সেতু। এটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্জিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার স্মারক। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের অনন্য মাইলফলক। দেশের অভুতপূর্ব উন্নয়নে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাংলার মানুষ শেখ হাসিনার মহিমান্বিত নেতৃত্বকে মূল্যায়ন করবে।
উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পর শেখ হাসিনা ব্যতিত আর কোনো নেতাই এতো ভাবেনি। দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে রাজনৈতিক দর্শন ও পরিকল্পনা নিয়ে মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করেনি। বাঙালির ভাগ্যোন্নয়নের সংগ্রামে শেখ হাসিনাই পরিপূর্ণ আত্মনিবেদন করেছেন। আজ সন্দেহাতীতভাবে একথা প্রমাণিত যে বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা মানেই মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন হওয়া। বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশ আরো মর্যাদাশীল হওয়া।
আবারো ফিরে আসি পদ্মা সেতুতে। অনেক চড়াই-উতরাই ও নানা ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে অবশেষে পদ্মা সেতু দুই প্রান্তের দুটো জেলাকে সংযুক্ত করেছে। তবে সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় ছিল অনেক বাধা, অর্থের সংস্থান নিয়েও ছিল গভীর অনিশ্চয়তা। প্রথমেই ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। দুর্নীতির অজুহাতে ঋণ প্রস্তাব বাতিল করেছিল বিশ্বব্যাংক। ছিল দেশে বিদেশে কঠোর সমালোচনা। এসবের পাশাপাশি ছিল প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জও। বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদী পদ্মা। এই নদীর তলদেশে মাটির স্তরের গঠন নিয়েও ছিল জটিলতা।
তবে এত জটিলতার বিপরীতে ছিলেন একজন স্টেটসম্যান শেখ হাসিনা। নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকা, আর নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসই ছিল পদ্মা সেতু গড়ার মূল ভিত্তি। শেখ হাসিনার ইষ্পাত সমান দৃঢ়তায় পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান। গর্বের সেতু আজ দাঁড়িয়ে আছে। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি সাহসী সিদ্ধান্ত তাকে একজন আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
স্বপ্নের পদ্মাসেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ২৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থেকে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন। এদিন সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই সেতু। সম্প্রতি পদ্মা সেতু পারাপারের জন্য টোলের হার নির্ধারণ করা হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে খুলে যাবে যোগাযোগের নতুন দুয়ার।
শুধু তাই নয়, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতে দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের অবসানও হবে। উদ্বোধনের প্রাক্কালে পদ্মা সেতু নিয়ে প্রশংসায় ভাসছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এখন দেশ থেকে বিদেশেও। তবে অন্য দেশের সেতুর নির্মাণ খরচের সঙ্গে পদ্মা সেতু খরচের তুলনা করার কোনো সুযোগই নেই। এ সেতুর কারণে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব নেতৃত্বে ঈর্ষণীয়ভাবে অনন্য উচ্চতায় অবস্থান ধরে রেখেছেন বাংলাদেশ ও জননেত্রী শেখ হাসিনা।
পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এই সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু হয়ে উঠবে।
ব্রাজিলের আমাজন নদীর পর প্রমত্তা পদ্মা বিশ্বে খরস্রোতা নদীর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। সেই পদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে স্বপ্নের সেতু। পদ্মার প্রবল স্রোত উপেক্ষা করে শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এখন নদীর উভয় তীরে দাঁড়ালেই দেখা যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু দিয়ে পারাপারের অপেক্ষা প্রায় দুই যুগের। সেতুটি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে। এ সেতু যোগাযোগ, বাণিজ্য, শিল্প, পর্যটন এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। বিশেষত এটি ভুটান, ভারত এবং নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য ও পর্যটনের জন্য আরও দ্রুত সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করবে। পদ্মা সেতু বার্ষিক জিডিপিতে এটি প্রায় ১ দশমিক ২ শতাংশ অবদান রাখবে। দারিদ্র্য হ্রাস করবে ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়াবে। এটি দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিনিয়োগের দরজা খুলে দেবে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে সরাসরি বাংলাদেশের প্রধানতম স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সমীক্ষায় দেখা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকার যাতায়াত সময় ১০ শতাংশ হ্রাস পেলে অর্থনৈতিক আয় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প মূল্যায়ন দলিল অনুসারে, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধি ১ দশমিক ৭ শতাংশ হবে এবং এতে জাতীয় জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধি হবে শূন্য দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। দেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী পদ্মার ওপর নির্মিত ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও রেলসেতু দেশের প্রধানতম এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ সেতু। সেতুটির ওপরের স্তরে চার লেনের মহাসড়ক ও নিচের স্তরে একটি রেলপথ বিদ্যমান।
পূর্ণ উদ্যমে শুরু হলে সেতুটির ওপর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৭৫,০০০ যানবাহন চলাচল করবে। মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর জেলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত হবে এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ স্থপিত হবে। অর্থাৎ দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষের সোনালি ভবিষ্যতকে দেশের অপরাপর অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের জিডিপি আনুমানিক ২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করবে। প্রকারান্তরে জাতীয় জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমিত। যোগাযোগ, সংযোগ ও অর্থনীতির সূচক ছাড়াও এই সেতুতে এক টাকা বিনিয়োগ থেকে দ্বিগুণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সুবিধা অর্জিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সুতরাং, পদ্মা সেতুকে কেবল রড-সিমেন্টের সেতু বা এর স্থাপনাকে প্রকৌশলগত অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা সমীচীন হবে না। বরং একে প্রযুক্তি, শিক্ষা, উন্নয়ন, ভূরাজনীতি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে হবে।
৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থের এই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ৭ ডিসেম্বর ২০১৪। প্রথম দিকে নির্মাণ ব্যয় কম নির্ধারণ হলেও পরবর্তীতে কয়েক দফা সেটা বৃদ্ধি পেয়ে সর্বশেষ ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। নির্মাণ সময় ও নির্মাণ ব্যয় দুটোই বাড়ে। সেতুটির সাথে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজনীতি সম্পর্কিত। সেতুটি নির্মাণ করা ছিল সরকারের একটি বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরুণে সরকার বদ্ধপরিকর ছিল। সেতুটি খুলে দেয়ার পর সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে দেশের অর্থনীতি। দেশের অর্থনীতির চেহারাই বদলে যাবে। কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। রাজধানীতে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল থেকে কৃষি পণ্য পরিবহনে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সৃষ্টি হবে। কৃষকেরা পণ্যের ভালো মূল্য পাবে।
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের একটি অংশে পরিণত হতে পারে এই পদ্মা সেতু। যোগাযোগ এবং পরিবহন খাতে রীতিমতো বিপ্লব সাধিত হবে। সেতুটিকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। সেতুর মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর অংশে ৬ লেন বিশিষ্ট একপ্রেসওয়ে তৈরি করা হয়েছে যা অত্যন্ত নয়নাভিরাম ও মনোমুগ্ধকর। রাতের এক্সপ্রেসওয়ে এক ভিন্ন রূপ ধারণ করে।
লেখক: সদস্য, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপকমিটি, আওয়ামী লীগ