সবার কাছে প্রয়োজনীয় একটি সম্পদ হচ্ছে জমি। আপনার জমি নেই বা অনেক জমি রয়েছে তবুও জমি ক্রয় করার আগ্রহ আপনার আছে।
বাংলাদেশ ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমি সেবায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ফলে যে কেউ এখন অনলাইনে জমির মালিকানা যাচাই করা কিংবা মোবাইলেই জমির খতিয়ান বের করে নিতে পারবে।
জমির খতিয়ান বা পর্চা কি?
খতিয়ান বা পর্চা একই জিনিস। জমির মালিকানা প্রমাণের সরকারি যে দলিল তাকে খতিয়ান বলে। বিভিন্ন এলাকায় এটাকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়।
আইনিভাবে খতিয়ানের পরিচয়- আইনিভাবে বলতে গেলে বলা যায় সরকারীভাবে জমি জরিপ করার সময় জরিপের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশ ফরম নং ৫৪৬২ (সংশোধিত) তে ভুমির মালিকানা/ দাগের বর্ণনাসহ যে নথিচিত্র প্রকাশ করা হয় তাকে খতিয়ান বলে।
খতিয়ানে কি কি উল্লেখ থাকে?
জমির খতিয়ানে মালিকানা তথ্য সহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেক থাকে। যেমন-
* জমির দখলে যে আছে তার নাম, তার ঠিকানা, তার পিতার নাম ও দখলদার কোন শ্রেণীভুক্ত।
* দখলদার বা প্রজা কর্তক নিদিষ্ট জমির অবস্থান করা, পরিমান ও সীমানা।
* খতিয়ানে থাকতে হবে জমির মালিকের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা।
* জমি ক্রয়ের সময় এস্টেটের মালিকের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা।
* খতিয়ান তৈরি করার সময় খাজনার পরিমান ও ২৮,২৯,৩০ বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত খাজনা। গরু চরণভুমি, বনভুমি ও মৎস খামারের জন্য ধারণকৃত অর্থ।
* খাজনার নির্ধারিত পদ্ধতির বিবরণ।
* নির্ধারিত এবং ন্যায়সঙ্গত খাজনা জমির ২৬ ধারা মোতাবেক ।
* খাজনা বৃদ্ধিক্রম থাকলে তার বিবরণ।
* জমির মালিকের কর্তব্য ও অধিকার ইজারাকৃত জমির ক্ষেত্রে।
* প্রজাস্বত্বের গুরুত্তপুরনু শর্ত ও তার পরিনতি।
* জমি সংলগ্ন অন্যান্য অধিকার ও পথ চলার অধিকার।
* নিজস্ব জমি হলে তার বিবরণ।
* এরিয়া নং, দাগ নং, মৌজা নং, খতিয়ান নং, জেএল নং, বাট্রা নং ইত্যাদি উল্লেখ থাকে।
মাঠ পর্চা কি বা মাঠ পর্চা কাকে বলে?
জমি জরিপ করার সময় জমির মালিকদেরকে একটি খসড়া খতিয়ান দেওয়া হয় তাকে মাঠ পর্চা বলে। এটাতে কোন প্রকার ভুল থাকলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সহজেই সংশোধন করে নেওয়া যায়।
চুড়ান্ত খতিয়ান প্রকাশের আগে সুতরাং বলা যায় যে জমির মালিকরা যে খসড়া খতিয়ান ব্যবহার করে তাকে মাঠ পর্চা বলে।
খতিয়ানের প্রকারভেদ
আমাদের দেশে এ যাবৎ তিনটি জরিপ হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী জমির খতিয়ান বিভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন-
সিএস খতিয়ান
এসএ খতিয়ান
আরএস খতিয়ান
বিএস খতিয়ান/সিটি জরিপ
আর এস খতিয়ানে বিএস খতিয়ান /সিটি জরিপ অন্তভুক্ত সেই হিসাবে খতিয়ান তিন প্রকার।
সিএস খতিয়ান। (Cadastral Survey)
এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম যে জরিপ হয় সেটাই হচ্ছে সিএস খতিয়ান (Cadastral Survey)। এই জরিপ ১৮৮৭ সালে শুরু হয়ে ১৯৪০ সালে শেষ হয়।
এই জরিপ কক্সবাজারের রামুতে শুরু হয় এবং দিনাজপুরে শেষ হয়। জরিপ চলাকালে সিলেট আসাম প্রদেশ এর সাথে সংযুক্ত এবং পার্বত্য চট্রগ্রাম জমিদারি প্রথার সাথে বাঙ্গালীদের বিরোধ থাকায় এই দুটি অঞ্চল সিএস জরিপের আওতায় আনা হয় নাই।
বাংলাদেশের সর্বপ্রথম জরিপ হচ্ছে সিএস জরিপ এবং এর খতিয়ানকে সিএস খতিয়ান বলা হয়।
এই খতিয়ান উপর থেকে নিচ লম্বালম্বিভাবে হয়। একদম উপরে বাংলাদেশ ফরম নং ৫৪৬৩ লিখা থাকে।
এসএ খতিয়ান । (State Acquisition Survey)
১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হয়। আইন পাশের পর ততকালিন সরকার জমিদারি অধিগ্রহণ সাবস্ত করেন।
এই সময় সরকারি আমিনগণ সরেজমিন অর্থাৎ মাঠে না গিয়ে অফিসে বসে সিএস খতিয়ান সংশোধন করে খতিয়ান তৈরি করেন। এটাকে এসএ খতিয়ান বলে। কোন কোন অঞ্চলে এ খতিয়ানকে টেবিল খতিয়ান বা ৬২ খতিয়ান বলা হয়।
সরেজমিন জায়া হয় না এ জরিপ পরিচালনা করার সময় এ কারনে এ খতিয়ানে অনেক ধরণের অসমতা দেখা দেয়।
এক পৃষ্ঠায় হয়ে থাকে এই খতিয়ান কখনও প্রিন্ট হয় না অর্থাৎ হাতে লেখা খতিয়ান হচ্ছে এসএ খতিয়ান।
আরএস খতিয়ান। (Revisional Survey)
সিএস খতিয়ান সম্পন্ন হওয়ার ৫০ বছর অতিক্রম করে আরিএস জরিপ শুরু হয়। আগের খতিয়ানের ভুল সংশোধন করে এতটাই স্বচ্ছ করা হয় যে, মালিকানা, দখলদার বিরোধ কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করার ক্ষেত্রে এটির উপর নির্ভর করতে হয়।
বাংলাদেশ খতিয়ানও বলা হয় খতিয়ানকে কারন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই জরিপ পরিচালনা করা হয় বলে।
আরএস খতিয়ান সিএস খতিয়ানের মত লম্বালম্বি দাগ টানা থাকে তবে এটি এক পৃষ্ঠায় হয়। ফরমের একদম উপরে হাতের ডান পাশে ‘রেসার্তে নং’ লেখা থাকে।
বিএস খতিয়ান/সিটি জরিপ। (City Survey)
বাংলাদেশে সর্বশেষ যে জরিপ (1998-1999 সালে) অনুষ্ঠিত হয় যেটার কাজ এখন চলমান রয়েছে। টাকা অঞ্চলে এটা মহানগর জরিপ হিসাবে পরিচিত লাভ করে।
বি এস খতিয়ানে ৯ টা কলাম থাকে এবং জমির ধরণ কি তা উল্লেখ থাকে। যেমন- চাষের জমি, পুকুর ইত্যাদি।
জমির মালিকানা বের করার প্রয়োজন হয় কেন?
জমি ক্রয় করার আগে ক্রয়কারিকে অবশ্যই মালিকানা যাচাই করে নিতে হয়। কেননা বাংলাদেশে প্রতারকের অভাব নেই। নকল মালিক সেজেও জমি বিক্রয় করার প্রতারণা করতে পারে অনেকেই।
জমি জমা নিয়ে অনেক সময় বিরোধ মিমাংসা করার ক্ষেত্রেও জমির মালিকানা যাচাই করার প্রয়োজন হয়।
ওয়ারিশদের প্রাপ্ত সম্পত্তি বন্টন করার আগেও মৃত ব্যক্তির মালিকানা যাচাই করার প্রয়োজন হতে পারে। কেননা অন্য কারো জমি দাপুটে ভোগদখল করার নজির আমাদের দেশে আছে।
জমির মালিকানা যাচাই করার নিয়ম
বর্তমানে আপনি দুইভাবে জমির মালিকানা যাচাই করতে পারবেন। যেমন –
১। আপনার যদি কোন খতিয়ান নিয়ে সন্দেহ হয় তাহলে খতিয়ানটি নিয়ে নিকতস্ত সেটেলমেন্ট অফিসে গিয়ে খতিয়ানের ভলিয়াম দেখুন।
ভলিয়মের সাথে আপনার খতিয়ান মিল থাকলে খতিয়ানটি সঠিক নয়তো জালিয়াতি করা হয়েছে।
২। অনলাইনের মাধ্যমেও খতিয়ানটি যাচাই করে নিতে পারেন নিজে নিজেই। আপনি যদি স্মার্টফোন ব্যবহার করে থাকেন তাহলে সেটে ইন্টারনেট সংযোগ করে অনলাইনে জমির কাগজ দেখতে পারেন।
কিভাবে জমির খতিয়ান উঠাবেন বা খতিয়ান বের করার নিয়ম ?
খতিয়ান উঠানো বা বর্তমানে খতিয়ান বের করার দুটি পদ্ধতি রয়েছে। একটি হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতি অপরটি হচ্ছে মেনুয়াল পদ্ধতি।
ডিজিটাল পদ্ধতিতে আপনি দু প্রকার খতিয়ান উঠাতে পারবেন। খতিয়ানের অনলাইন কপি এবং ডাক যোগে খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি পাওয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন।
জমির খতিয়ান উঠানোর সহজ পদ্ধতি হচ্ছে-
* জমির দাগ নাম্বার বা খতিয়ান নাম্বার নিয়ে সেটেলমেন্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে খতিয়ান তোলা।
সেটেলমেন্ট থেকে খতিয়ান উঠাতে ১০০ (একশত) টাকা খরচ হয়। আর অনলাইনে খতিয়ান উঠাতে ৫০ টাকা খরচ লাগবে।