আধুনিক কবি জসীম উদ্‌দীন

রোকন উদ্দিন
যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পড়া অবস্থায় তারই লিখিত কাব্য স্থান পেয়েছিল একই প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে। যাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে চিঠি দিয়ে ডেকে নিয়েছিলেন শান্তি নিকেতনে, যার কবিতা পড়ে অশ্রুশিক্ত হয়েছেন ড: দীনেশচন্দ্র সেনের মতো কথা সাহিত্যিক, যার সাথে সখ্যতা ছিল বিখ্যাত পরিচালক বাংলা সিনেমার দিকপাল মৃনাল সেনের, এতই সখ্যতা ছিল যে- মৃনাল সেনের মা’কে তিনি মা বলেই ডাকতেন। কী পরিমাণ সখ্যতা থাকলে মৃনাল সেনের মা’কে মা বলেই ডাকতেন তিনি! এতক্ষণে হয়তো মানুষটিকে চিনে নিয়েছেন। বলছি বিখ্যাত কবি জসীম উদ্‌দীনের কথা। সাহিত্যের জগতে পল্লীকবি নামে বিচরন করছেন যুগের পর যুগ। যিনি বাংলার ঘরে ঘরে পল্লী কবি হিসেবে জীবিত রয়েছেন বছরের পর বছর। যার ছাত্রাবস্থাতেই তার লিখিত ‘কবর’ কবিতাটি স্থান পায় পাঠ্যবইতে।
আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি জসীম উদদীন। যার মনে ছিল বাংলার পল্লী জগতের আনন্দ-বেদনা, মর্মব্যথা যা সে তার কলমের মাধ্যমে ফুঁটিয়ে তুলেছেন। বাংলা মাঁটির গন্ধ যার কলমের শোভায় স্থান করে নিয়েছে সাহিত্যের জগতে। চিরায়িত বাংলাকে তিনি উপস্থাপন করেছেন কবিতার ছন্দে। বাংলার যাপিত রূপকে আধুনিক যুগের সাথে মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছেন তিনি বাংলা কবিতার মাধ্যমে। যার প্রতিটি শব্দের গাথুঁনীতে নিখুঁতভাবে পল্লী জননীর মর্মবেদনা উপস্থাপিত হয়েছে নিপুণভাবে। যে গ্রাম-বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে সর্বদা ছিল উপেক্ষিত, তা তিনি পরম মমতায় তুলে রেখেছেন শব্দের গাঁথুনিতে।
বাংলার বিখ্যাত সকল সাহিত্যিকরা যেখানে নিজের সাহিত্য কর্ম তৈরি করেছেন কোনো বিদেশী বিখ্যাত লেখকের অনুকরণে ঠিক তখন সেই ধারায় প্রবেশ না করেই তিনি নিজেই একটি সাহিত্য ধারা তৈরি করে সেখানে বাংলার পল্লীবাসিকে উপজীব্য করেছেন। উপস্থাপন করেছেন শিক্ষিত সমাজের কাছে। বিশেষ করে তিনি বাংলার দরিদ্র কৃষক, দিনমজুর, রাখালের যাপিত জীবনের সাদাকালো জীবনকে উপস্থাপন করে গেছেন আধুনিক সমাজের কাছে। দরদ মিশ্রিত শব্দচয়নের মাধ্যমে বাংলার দুঃখ-কষ্ট তুলে ধরেছেন।
এ সম্পর্কে পল্লীকবি নিজেই বলেছেন- তাহাদের (গ্রামবাসীদের) দুঃখ ও শোষণ পীড়নের কাহিনী বলিয়া শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সহানুভ’তি জাগাতেই চেষ্টা করি। আর চাই, যারা দেশের এ অগনিত জনগণকে তাহাদের মুখের আহার কাড়িয়া লইয়া তাহাদিগকে দারিদ্রের নির্বসানে ফেলিয়া রাখে, তাহাদের (শাসকদের) বিরুদ্ধে শিক্ষিত সমাজের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাইতে তিনি লিখেন। বিবিসিকে একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন- “গ্রাম তো আমার, এদের কথাই তো আমি বেশি জানি। এইজন্যই আমি তাদের নিয়ে লিখেছি।”
জসীম উদ্‌দীন একজন আধুনিক ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, ভ্রমণকাহিনীকার, শিশুসাহিত্যিক, নাট্যকার, কাব্যোপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক সহ নানাবিধ পরিচয়ে পরিচিত। তার বহুলপঠিত ‘কবর’ কবিতা তার ছাত্রাবস্থাতেই স্থান করে নেয় পাঠ্যসূচিতে, ১৯৪০ সালের মধ্যে আরো একটি বিখ্যাত কাব্য ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্ববিখ্যাতে রূপ নেয়। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ১৯৬৯ ইউনেস্কোর অনুবাদ প্রকল্পে দ্বিতীয় গ্রন্থ হিসেবে অনূদিত হয়।

আরও পড়ুন : নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের জন্মবার্ষিকী
পল্লী কবি শুধু নিজেকে পল্লী জননীর দুঃখ কষ্টের গাঁথুনিতে আবদ্ধ রাখেননি। রাজনৈতিক অঙ্গনেও তার বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। জানা যায়, সামাজিক ও জাতীয় প্রশ্নে উঠাবসা ছিল মার্শাল টিটো, কমরেড মনি সিং, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, চৌ এন-লাই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আইয়ুব খান, লেখক কুদরত উল্লাহসহ বিশ্বের প্রখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে। এছাড়াও যুবক বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল, নন্দলাল বসু, জয়নুল আবেদীন প্রমুখ ব্যক্তিদের সাথে নিয়মিত উঠাবসা ছিল তার। ১৯২৫ সারে ফরিদপুর অনুষ্ঠিত বৃটিশ বিরোধী অলবেঙ্গল কংগ্রেস, অলবেঙ্গল স্টুডেন্ট কংগ্রেস, অলবেঙ্গল মুসলিম কংগ্রেস এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দুই দিন ব্যাপী সেই সম্মেলনে তিনি স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তখনকার বিখ্যাত সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। তার মধ্যে রয়েছেন- মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু, সরোজিনী নাইডু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। ১৯২৬ সালে রাজনৈতিক কারণে কাজী নজরুল যখন ফরিদপুর আসেন তখন তিনি সরাসরি পল্লী কবির নিজ বাড়িতে উঠেছিলেন। রাজনৈতিক মতাদর্শে মুগ্ধ হয়ে কবি নিজের লিখিত ‘যে দেশে মানুষ বড়’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন কমিউনিস্ট নেতা মনি সিংহ কে।
ফরিদপুরের মাটিতে বেড়ে ওঠা কবি দেশে বিদেশে প্রচুর ভ্রমণ করেছেন। দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে লোক সাহিত্য সংগ্রহ করেছেন অনেক। তার সংগ্রহে ছিল ১০,০০০ এরও বেশি লোক সংগীত, যার কিছু অংশ তার সংগীত সংকলন, জারি ও মুর্শিদ গানে স্থান পেয়েছে। এসকল গানের মধ্যে রয়েছে- “আমার হার কালা করলাম রে, আমায় ভাসাইলি রে, আমায় এতো রাতে, ও বাজান চল যাই মাঠে লাঙল বাইতে, কাজল ভ্রমরা রে” সহ আরো বেশ জনপ্রিয় গ্রাম্য সংগীত।
কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- “রাখালী, নকশী কাঁথার মাঠ, ধানখেত, সোজন বাদিয়ার ঘাট, হাসু, এক পয়সার বাঁশী, মাঁটির কান্না, মায়াবতী, মহররম ইত্যাদি।” যার মধ্যে “নকশী কাঁথার মাঠ” কাব্যটি “দি ফিল্ড অব এমব্রয়ডার্ড কুইল্ট” “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যগ্রন্থটি “জিপ্সিওয়ার্ফ” শিরোনামে ইংরেজিসহ আরোও বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এর পাশাপাশি “বাঙালীর হাসির গল্প” গ্রন্থটি “ফোক টেলস অব ইস্ট পাকিস্তান” নামে অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও তার কলমে তুলে এনেছেন নাটক, আত্মকথা, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী।
১৯০৩ সালে ফরিদপুরে জন্ম হওয়া কবির বেড়ে ওঠার পুরোটা সময়ই গ্রামে ছিলেন। ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে পড়ালেখা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ এবং এম. এ শেষ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৩৮ সালে। ১৯৪৪ সালে প্রভাষক ছেড়ে যোগ দেন সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগে। ১৯৬২ সালে তিনি ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে অবসরে যান।
কবি তার জীবদ্দশায় বেশ কিছু পুরস্কারে ভ’ষিত হন। তার মধ্যে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর), একুশে পদক পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার (প্রত্যাখ্যান করেন), রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট উপাধি অর্জন করেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। কবির শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে তার দাদীর কবরের পাশে ফরিদপুরেই দাফন করা হয়। তাকে স্মরণ করে প্রতিবছর তার জন্মদিনকে কেন্দ্র করে একটি গ্রামীন পাক্ষিক মেলার আয়োজন করা হয় ফরিদপুরে। এছাড়াও তার বাসভবনে তার স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে উঠেছে জাদুঘর বা সংগ্রহশালা। যেখানে তার ব্যবহৃত বিভিন্ন তৈজসপত্র সংরক্ষিত আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *