উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের ৬৬ তম জন্মদিন আজ। ১৯৫৬ সালের এই দিনে ফরিদপুরের ভাঙ্গার নুরপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মশিউর রহমান মাসুদ ও মা নুরুন নাহার মাসুদ।
তারেক মাসুদ ছিলেন একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক ও গীতিকার। দেশে প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলন শুরু করেন তিনি। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। সেদিন তারেক মাসুদ তার সহকর্মীদের নিয়ে পাবনার ইছামতি নদীর তীরে ‘কাগজের ফুল’ নামের একটি ছবির শুটিংয়ের স্থান নির্বাচন করতে যান।
স্থান নির্বাচনের পর দুপুর ১২ টা ২০ মিনিটে গাড়িবহর নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন নির্মাতা। পথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঘিওরে নামক স্থানে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাসের সঙ্গে তারেক মাসুদকে বহনকারী মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
সে সময় তারেক মাসুদের সঙ্গে ছিলেন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী সাংবাদিক ও বিশিষ্ট আলোকচিত্রী মিশুক মুনীর। একই দুর্ঘটনায় তিনিও মারা যান। এ ছাড়া ওই দুর্ঘটনায় তিনজনসহ মোট পাঁচজনের মৃত্যু হয়। তারেক মাসুদ সম্পর্কে চলচ্চিত্র দর্শকদের ধারণা কী? দর্শক কতটুকু জানেন?
চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে খ্যাতি পাওয়া তারেক মাসুদ মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। ভাঙ্গা ঈদগাহ মাদ্রাসা থেকে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পরে ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। মাওলানাও সেখান থেকে পাশ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তার মাদ্রাসা শিক্ষা শেষ হয়।
এরপর তারেক মাসুদ বঙ্গ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করে ডকুমেন্টারি তৈরি শুরু করেন।
প্রায় ২০ বছর ধরে এ কাজে যুক্ত ছিলেন তারেক মাসুদ। এরপর চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে নামেন। ২০০২ সালে তার প্রথম ছবি ‘মাটির ময়না’ মুক্তি পায়। তার শৈশবের মাদ্রাসা জীবনের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে ছবিটি। যেটি সে বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল।
এরপর তারেক মাসুদ ‘আদম সুরত’, ‘মুক্তির গান’, ‘অন্তরযাত্রা’, ‘রানওয়ে’সহ একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার এবং চ্যানেল আই চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
এছাড়াও তিনি ফিল্ম সাউথ এশিয়া, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, মারাকেচ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, থ্রি কন্টিনেন্টস ফেস্টিভ্যাল, ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ভিডিও ফেস্টিভ্যাল, কারা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ডিরেক্টরস গিল্ড অফ গ্রেট ব্রিটেন, ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব বাংলাদেশ-এ পুরস্কৃত হয়েছেন।
তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এই দম্পতির বিংহাম পুত্র মাসুদ নিষাদ নামে একটি ছেলে রয়েছে। স্ত্রী ক্যাথরিন এবং তারেক মাসুদ ঢাকায় অডিওভিশন নামে একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়াও তারেক মাসুদ লোকসংগীত ও লোকজ ধারার প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতার মৃত্যুর পর, ২০১২ সালে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, চলচ্চিত্র সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলোকে একত্র করে বিভিন্ন সময়ে লেখা। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফিল্ম জার্নি’। বইটির ভূমিকা লিখেছেন তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ।
তারেক মাসুদের সবসময় লেখক হওয়ার একটা টান ছিল। তাই তিনি বললেন, ‘ফিল্মমেকার না হলে লেখক হওয়ার চেষ্টা করতাম।’